বাংলাদেশ দণ্ডবিধি - ১৮৬০ ও ফৌজদারি কার্যবিধি - ১৮৯৮ অনুসারে ফৌজদারি অপরাধ সমূহের প্রাথমিক ধারণা | Basic Concepts of Criminal Offenses under the Penal Code, 1860 and the Code of Criminal Procedure, 1898
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি - ১৮৬০ ও ফৌজদারি কার্যবিধি - ১৮৯৮ এর আলোকে ফৌজদারি অপরাধ সমূহের প্রাথমিক ও সংক্ষিপ্ত ধারণা | Basic Concepts of Criminal Offenses under the Penal Code - 1860 and the Code of Criminal Procedure - 1898)
উপস্থাপনা কথা:
মাত্রই ভুল। তাই তো আমাদের দৈনন্দিন জীবন গণনাহীন ভুলে ভরা। দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া
ভুলগুলি কখনো আমরা ইচ্ছায় করি আবার কখনো অনিচ্ছায় করি। কিন্তু ভুল তো ভুলই। হয়তো ইচ্ছায়
বা অনিচ্ছায় হওয়ার কারণে শাস্তিরও তারতম্য ঘটে। তবুও স্বীকার করতেই হবে যে, সব ভুলেরেই
একটা না একটা প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। আবার এই প্রায়শ্চিত্ত ও হতে পারে দু-ভাবে। যেমন-
ঐশ্বরিক আর জাগতিক। জাগতিক কিংবা ঐশ্বরিক কোন প্রায়শ্চিত্তই কেউ স্বেচ্ছায় করে না বরং
তারা বাধ্য হয় তাদের কৃতকর্মের জন্য প্রায়শ্চিত্ত বরণ করতে। ঐশ্বরিক প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ
সৃষ্টিকর্তার হাতে। তাঁর প্রদেয়/সৃষ্ট বিধান অনুযায়ী তিঁনি অপরাধীকে শাস্তি প্রদান
করবেন। আর জাগতিক শাস্তি প্রদান করার জন্য রয়েছে কিছু নিয়ম-কানুন। যেগুলির মধ্যে অন্যতম
ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮ (The Code of Criminal Procedure-1898) ও দণ্ডবিধি-১৮৬০ (Penal
Code-1860)। নিম্নে বাংলাদেশে বিদ্যমান ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮ (The Code of Criminal
Procedure-1898) এবং দণ্ডবিধি-১৮৬০ (Penal Code-1860) এর আলোকে প্রধান প্রধান ফৌজদারি
অপরাধের একটি তালিকা সংক্ষিপ্ত বিবরণসহ নিচে তুলে ধরা হলো।
উল্লেখ্য, দণ্ডবিধি
(Penal Code) অপরাধের সংজ্ঞা এবং শাস্তির বিধান বর্ণনা করে, অন্যদিকে ফৌজদারি
কার্যবিধি (Code of Criminal Procedure) সেই অপরাধের তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া
এবং অন্যান্য পদ্ধতিগত বিষয়াবলী নির্ধারণ করে। সুতরাং, অপরাধের বর্ণনা মূলত দণ্ডবিধিতে
পাওয়া যায়।
দণ্ডবিধি-১৮৬০ (Penal Code-1860) অনুযায়ী প্রধান ফৌজদারি
অপরাধসমূহের তালিকা ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ
দণ্ডবিধির
অধীনে অপরাধগুলোকে বিভিন্ন অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। প্রধান কয়েকটি বিভাগের অপরাধ নিচে
উল্লেখ করা হলো:
১. মানবদেহ সম্পর্কিত অপরাধ (Offences Affecting the Human Body):
- খুন (Murder - ধারা ৩০০): কোনো ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃতভাবে এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করা। এটি সবচেয়ে গুরুতর অপরাধগুলোর মধ্যে অন্যতম।
- দণ্ডনীয় নরহত্যা (Culpable Homicide - ধারা ২৯৯): মৃত্যু ঘটানোর উদ্দেশ্যে বা কারো মৃত্যু হতে পারে জেনে এমন কোনো কাজ করা, যা সাধারণত আইন অনুযায়ী খুন হিসেবে গণ্য হয় না। খুন ও দণ্ডনীয় নরহত্যার মধ্যে আইনের সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে।
- আঘাত ও গুরুতর আঘাত (Hurt and Grievous Hurt - ধারা ৩১৯ ও ৩২০): কাউকে শারীরিক যন্ত্রণা দেওয়া হলো 'আঘাত'। আর যদি সেই আঘাত গুরুতর হয় (যেমন: হাড় ভেঙে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়া), তবে তা 'গুরুতর আঘাত' বলে গণ্য হয়।
- অপহবণ ও অপহরণ (Kidnapping and Abduction - ধারা ৩৬০-৩৬২): আইনসম্মত বা আইনদ্বারা স্বীকৃত অভিভাবকের কাছ থেকে কোনো নাবালককে বা কোনো ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর পূর্বক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া।
- ধর্ষণ (Rape - ধারা ৩৭৫): কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে, সম্মতি ছাড়া, বা ভয় দেখিয়ে সম্মতি আদায় করে তার সাথে যৌন সঙ্গম করা একটি গুরুতর অপরাধ।
- যৌতুকের
জন্য নির্যাতন বা হত্যা (Dowry-related Torture or Death): যৌতুকের দাবিতে কোনো বিবাহিত
নারীকে নির্যাতন, গুরুতর আঘাত করা বা হত্যা করা।
২. সম্পত্তি সম্পর্কিত অপরাধ (Offences Against Property):
- চুরি (Theft - ধারা ৩৭৮): কোনো ব্যক্তির দখল থেকে তার সম্মতি ছাড়া কোনো অস্থাবর সম্পত্তি অসাধুভাবে নিয়ে যাওয়া।
- বলপূর্বক গ্রহণ বা চাঁদাবাজি (Extortion - ধারা ৩৮৩): কোনো ব্যক্তিকে ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে কোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান বস্তু আদায় করা।
- দস্যুতা ও ডাকাতি (Robbery and Dacoity - ধারা ৩৯০ ও ৩৯১): চুরি বা চাঁদাবাজির সময় যদি মৃত্যু বা আঘাতের ভয় দেখানো হয়, তবে তা 'দস্যুতা'। আর যদি পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তি একসাথে দস্যুতা করে, তবে তাকে 'ডাকাতি' বলা হয়।
- সম্পত্তি আত্মসাৎ (Criminal Misappropriation of Property - ধারা ৪০৩): অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো অস্থাবর সম্পত্তি আত্মসাৎ করা বা নিজের ব্যবহারে লাগানো।
- প্রতারণা
(Cheating - ধারা ৪১৫): কাউকে
ছলনা করে কোনো সম্পত্তি প্রদানে প্ররোচিত করা বা এমন কোনো কাজ করানো যা তার জন্য
ক্ষতিকর।
৩. রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ (Offences Against the State):
- রাষ্ট্রদ্রোহিতা (Sedition - ধারা ১২৪ক): কথা, লেখা বা ইঙ্গিতের মাধ্যমে আইনসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করা বা করার চেষ্টা করা।
- সরকারের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা (Waging war against the Government - ধারা ১২১): রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
করা বা করার চেষ্টা করা বা ঘোষণা করা।
৪. জনশৃঙ্খলা ও জনশান্তি বিরোধী অপরাধ (Offences Against Public Tranquility):
- দাঙ্গা (Rioting - ধারা ১৪৭): বেআইনি সমাবেশের কোনো সদস্য যদি সহিংসতা বা বলপ্রয়োগ করে, তখন তাকে 'দাঙ্গা' বলে।
- বেআইনি
সমাবেশ (Unlawful Assembly - ধারা ১৪১): পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তি যদি কোনো সাধারণ অপরাধমূলক
উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়।
৫. মানহানি (Defamation):
- মানহানি
(Defamation - ধারা ৪৯৯): কোনো
ব্যক্তির সম্মানহানি করার উদ্দেশ্যে তার সম্পর্কে মিথ্যা ও ক্ষতিকর কিছু বলা,
লেখা বা প্রকাশ করা।
৬. জালিয়াতি সম্পর্কিত অপরাধ (Offences Relating to Forgery):
- জালিয়াতি (Forgery - ধারা ৪৬৩): обман করার উদ্দেশ্যে কোনো মিথ্যা দলিল বা ইলেকট্রনিক রেকর্ড তৈরি করা।
- জাল
নোট বা মুদ্রা তৈরি (Counterfeiting Coin/Currency - ধারা ২৩১-২৪৩): নকল টাকা বা মুদ্রা তৈরি করা
বা জেনেশুনে ব্যবহার করা।
পরিশেষে বলা যায় যে, এই নিবন্ধটি তে উপস্থাপিত ফৌজদারী অপরাধ সমূহের প্রাথমিক ও সংক্ষিপ্ত ধারণা সম্মানিত পাঠক মহোদয়গণের জ্ঞাতার্থে সচেতনতা বৃদ্ধিতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করবে। ভাল লাগলে লাইক, কমেন্টস ও শেয়ার করতে ভুলবেন না যেন।
পোস্ট কি-ওয়ার্ডস:
বাংলাদেশের
দণ্ডবিধি ১৮৬০ | The Penal Code, 1860 of Bangladesh | ফৌজদারি অপরাধের তালিকা | List
of Criminal Offenses | খুন, চুরি ও ডাকাতির শাস্তি | Punishment for Murder,
Theft, and Dacoity | বাংলাদেশে ফৌজদারি আইন | Criminal Law in Bangladesh | দণ্ডবিধি
ও ফৌজদারি কার্যবিধির পার্থক্য | Difference between the Penal Code and the Code
of Criminal Procedure | বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থা | Law and Justice
System of Bangladesh | ফৌজদারি মামলার procedure (কার্যপ্রণালী) | Criminal Case
Procedure | অপরাধ ও শাস্তি আইন বাংলাদেশ | Crime and Punishment Law in
Bangladesh
Frequently Asked Questions
প্রশ্ন ১: দণ্ডবিধি
(Penal Code) এবং ফৌজদারি কার্যবিধি (CrPC) এ দুটির মাঝে মৌলিক পার্থক্য কী?
উত্তর: দণ্ডবিধি, ১৮৬০ হলো একটি মৌলিক বা তত্ত্বগত আইন (Substantive Law), যা বিভিন্ন অপরাধের সংজ্ঞা দেয় এবং সেই অপরাধের জন্য শাস্তি কি হবে তা নির্ধারণ করে। অন্যদিকে, ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ হলো একটি পদ্ধতিগত আইন
(Procedural Law), যা কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ কীভাবে তদন্ত করবে বা তদন্ত করার পদ্ধতি কি হবে, অপরাধকারী বা আসামীকে
কীভাবে গ্রেপ্তার করা হবে এবং আদালতে উক্ত অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া কীভাবে চলবে তা নির্ধারণ করে।
প্রশ্ন ২: চুরি
(Theft) এবং দস্যুতার (Robbery) মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: চুরি হলো কারো অজান্তে বা সম্মতি
ছাড়া তার অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে যাওয়া। এখানে বলপ্রয়োগ বা ভয়ের উপাদান থাকে না। কিন্তু
চুরির সময় যদি অপরাধী ভুক্তভোগীকে আঘাত করে, বা মৃত্যু বা আঘাতের ভয় দেখায়, তখন সেটি
দস্যুতায় পরিণত হয়।
প্রশ্ন ৩: খুন
(Murder) এবং দণ্ডনীয় নরহত্যার (Culpable Homicide) মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: উভয় ক্ষেত্রেই মৃত্যু ঘটানো হয়,
কিন্তু উদ্দেশ্য ও পারিপার্শ্বিকতার ওপর ভিত্তি করে পার্থক্য করা হয়। যখন পূর্বপরিকল্পনা
ও সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায় নিয়ে কাউকে হত্যা করা হয়, তখন তা সাধারণত খুন। কিন্তু যদি আকস্মিক
উত্তেজনা বা আত্মরক্ষার সীমা অতিক্রম করার মতো পরিস্থিতিতে মৃত্যু ঘটে, যা খুন হিসেবে
গণ্য হওয়ার মতো গুরুতর নয়, তখন তাকে দণ্ডনীয় নরহত্যা বলা হয়।
প্রশ্ন ৪: জামিনযোগ্য
ও জামিন-অযোগ্য অপরাধ বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: ফৌজদারি কার্যবিধিরতে অপরাধগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যার প্রথমটি হচ্ছে জামিনযোগ্য (Bailable) অপরাধ। জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া আসামীর আইনগত অধিকার। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে জামিন-অযোগ্য (Non-bailable) অপরাধ। জামিন-অযোগ্য কোন অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন দেওয়া বা না দেওয়া আদালতের বিবেচনাধীন বিষয়। সাধারণত কম গুরুতর অপরাধগুলো জামিনযোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
প্রশ্ন ৫: সাইবার অপরাধগুলো
কি দণ্ডবিধির অন্তর্ভুক্ত?
উত্তর: দণ্ডবিধিতে কিছু প্রতারণা বা জালিয়াতির
ধারা থাকলেও বিশেষভাবে সাইবার অপরাধ দমনের জন্য বাংলাদেশে "ডিজিটাল নিরাপত্তা
আইন, ২০১৮" (যা বর্তমানে "সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩" দ্বারা প্রতিস্থাপিত
হতে যাচ্ছে) রয়েছে। হ্যাকিং, অনলাইনে গুজব ছড়ানো, সাইবার বুলিং ইত্যাদি অপরাধের বিচার
এই বিশেষ আইনে করা হয়।
No comments